আলবার্ট আইনস্টাইনের এর প্রেম বা বৈবাহিক জীবন নিয়ে অতটা লুকোছাপা ছিল না। তাই হয়তো সহজেই বলে দেওয়া যায় মিলেভার সঙ্গে তাঁর রসায়নে চিড় ধরার কারণ।

 

বিখ্যাত এক সাহিত্যিক প্রায়ই বলেন, প্রেমের বিয়েতেও বিরক্তি আসে। একই ছাদের নিচে থাকতে থাকতে বৈবাহিক জীবনে বিরক্তি আসতে শুরু করে একসময়। আইনস্টাইনেরও বোধ হয় বৈজ্ঞানিক খ্যাতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলেভার সঙ্গটা একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছিল। নইলে পরিবারের অমতে প্রেমিকাকে বিয়ে করার পরও সেই সম্পর্কে ফাটল কেন ধরল? এর পেছনে কি শুধুই একঘেয়েমি কাজ করেছিল, নাকি এর নেপথ্যে ছিল ব্যক্তিত্বের সংঘাত কিংবা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব?

 

আলবার্ট আইনস্টাইন স্কুলজীবনে কিছুটা একগুঁয়ে আর প্রচণ্ড মেধাবী ছিলেন। কিছু কিছু ব্যাপারে তাঁর জ্ঞান ছিল শিক্ষকদের চেয়েও খানিকটা এগিয়ে। এ ধরনের ছেলেমেয়েদের যা হয়, আইনস্টাইনেরও তা–ই হলো। অনেক শিক্ষকের বিরাগভাজন হলেন, তাই ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলেন না। শেষমেশ জুরিখে একটি কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় সুইস মেয়ে মিলেভা ম্যারিকের। মিলেভা ভীষণ সুন্দরী নন, কিন্তু মেধাবী। অনেকটা আইনস্টাইনের মতোই।

 

দ্রুতই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হলো, কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধুত্ব গড়াল প্রেমে। সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করবেন। কিন্তু বাদ সাধেন আইনস্টাইনের মা। কারণ, মিলেভা দেখতে তেমন সুন্দরী নন, আইনস্টাইনের চেয়ে তাঁর বয়স সাড়ে তিন বছর বেশি, পায়ে খুঁত আছে, হাঁটেন খুঁড়িয়ে। ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’—মিলেভা সম্পর্কে আইনস্টাইনের মা পলিনের মনোভাব ছিল তেমন।

 

তিনি ভাবতেন, মেয়েটা একটা ডাইনি। জাদুটোনা করে তাঁর ছেলেকে বশ করেছে। অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে তিনি চিঠি লিখতেন মিলেভার মাকে। কিন্তু অনড় আইনস্টাইন, তাঁর জেদের কাছে ভেঙে পড়ে মায়ের দৃঢ় মনোবল। আইনস্টাইন গোপনে একদিন বিয়ে করেন মিলেভাকে। এই ঘরেই জন্ম হয় ছেলে আলবার্টের, আরও পরে হান্স আইনস্টাইনের।

গল্পটা খুব সাধারণ। গল্পের পেছনেও গল্প থাকে। বিয়ের আগেই আসলে আইনস্টাইনের এক কন্যাসন্তানের মা হয়েছিলেন মিলেভা। সেই শিশুর ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা জানা যায় না। তখনকার ইউরোপ ভীষণ রক্ষণশীল। অবিবাহিত মেয়ের মা হওয়াকে অত্যন্ত খারাপ চোখে দেখা হতো।

 

তাই আলবার্ট আইনস্টাইন বা মিলেভা কেউই তাঁদের বিবাহপূর্ব সন্তান সম্পর্কে ইতিহাসকে কিছু জানতে দেননি। কেউ কেউ মনে করেন, তাকে দত্তক দেওয়া হয়েছিল অন্য কারও কাছে। আবার কেউ মনে করেন, চার বছর বয়সেই মৃত্যু হয় আইনস্টাইনের প্রথম কন্যাসন্তানের। তবে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। শিশুটি যেন নীরবে জন্ম নিয়ে একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল।

তারপর আরও দুই সন্তানের জনক-জননী হন আইনস্টাইন-মিলেভা জুটি। মিলেভা অনেক কষ্ট করেছেন। আইনস্টাইনের একটি পিএইচডি ডিগ্রি জোটেনি, চাকরির বাজারেও প্রত্যাখ্যাত। শেষে বন্ধুর সহযোগিতায় সুইজারল্যান্ডের বার্নের পেটেন্ট অফিসে সামান্য একটি চাকরি শুরু করেন।

সেই দুঃসময়ে মিলেভা যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন সংসারের হাল। ওদিকে আইনস্টাইন অফিসের সময় চুরি করে দিস্তার পর দিস্তা সাদা কাগজ ভরিয়ে ফেলছেন গণিতের আঁকিবুঁকিতে। শেষ পর্যন্ত ১৯০৫ সালে এসে ঘুরে যায় আইনস্টাইনের জীবনের মোড়। সফল হয় অফিস থেকে চুরি করা সময়টুকুর পরিশ্রম। একে একে পাঁচ-পাঁচটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন তিনি।

 

এর মধ্যে একটি ছিল পরমাণুবিষয়ক, একটি আলোক তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা এবং তৃতীয়টি বিখ্যাত থিওরি অব রিলেটিভিটি–বিষয়ক প্রবন্ধ। এরপরই নড়েচড়ে বসে বিজ্ঞানবিশ্ব। আইনস্টাইনকেও আর চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক কাম অধ্যাপকের পদে চাকরি পান। পিএইচডিও জুটে যায় ইতিমধ্যে। তখন আইনস্টাইনের সংসার সোনায় সোহাগা হয়ে ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু হলো কিনা উল্টো!

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে—কথাটা বোধ হয় ঐতিহাসিক ভুল। শুধু নারী চাইলেই একটা সংসার ধরে রাখা সম্ভব নয়, যদি না তার পুরুষ জীবনসঙ্গী সেটি চায়। মিলেভা সাধ্যমতো সংসার সামলে রাখলে কী হবে, আলবার্ট আইনস্টাইনের বুকে তখন বাজছে নতুন প্রেমের সুর। ফিল্মস্টারের মতোই তাঁর তারকাখ্যাতি। যেখানেই যান একঝাঁক ললনার ভিড় লেগে থাকে তাঁকে ঘিরে। আইনস্টাইনও প্রশ্রয় দেন তাঁদের।

 

১৯১৩ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন এর  স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফিরে আসেন নিজের দেশে। বার্লিনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদে যোগ দেন। এরপরেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আইনস্টাইন। কারণ, খালাতো বোন এলসার প্রেমে নতুন করে মজেছেন তিনি। নতুন করে। কারণ, কৈশোরেও দুজনের মন দেওয়া–নেওয়া হয়ে গিয়েছিল।

 

কিন্তু এলসা আর আলবার্ট আইনস্টাইন এর  মাঝে ঘটে তৃতীয় একজনের আবির্ভাব। মেরি নামের ভয়াবহ এক সুন্দরীর মোহ আইনস্টাইনকে ভুলিয়ে দেয় এলসার প্রেম। ফলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় এলসা ও আলবার্ট আইনস্টাইনেরআইনস্টাইনের প্রেমপর্ব। অনেক দিন পরে, যখন আইনস্টাইনের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, এলসারও বিবাহযোগ্য দুটো মেয়ে আছে, তখন কিনা ফিরে এলেন আইনস্টাইন!

এলসার তত দিনে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আইনস্টাইনের খ্যাতিও পৌঁছে গেছে তাঁর কানে। এলসা তখন বার্লিনে বাস করেন। সুতরাং আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর দেখা হতে থাকে নিয়মিত। পুরোনো প্রেমের রাগিণী বাজে দুজনের অন্তরে। বিষয়টা মিলেভার কান পর্যন্ত গড়াতে সময় লাগেনি।

 

স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধ বেধে যায় সংসারে। কিন্তু মিলেভা তাঁর মহাপরাক্রমশালী স্বামীর সঙ্গে পেরে ওঠেন না। আলবার্ট আইনস্টাইন তখন হিটলারের মতো আচরণ শুরু করেছেন বাড়িতে, আরোপ করেছেন নানা বিধিনিষেধ। আলবার্ট আইনস্টাইনের জামাকাপড় যেন পরিপাটি থাকে সব সময়, রিডিং রুম যেন সব সময় গোছানো থাকে এবং অন্য কেউ যেন তাঁর ডেস্ক, বই, খাতাপত্র ইত্যাদি স্পর্শ না করে, সেদিকে মিলেভাকে লক্ষ রাখতে হবে।

 

মনে হতে পারে, এ তো সামান্য ব্যাপার, আটপৌরে বাঙালি পরিবারে তো অহরহ এমনটা ঘটে। মনে রাখতে হবে, বিশ শতকের প্রথম ভাগ হলেও ঘটনাটা ঘটছে ইউরোপের সুইজারল্যান্ডে, নারী স্বাধীনতায় সে যুগেও তারা যোজন যোজন এগিয়ে। আরও কড়া শর্ত ছিল আলবার্ট আইনস্টাইনের, কখনো মিলেভা নিজে থেকে স্বামীর সঙ্গ চাইবেন না কিংবা নৈকট্য লাভের আশা করবেন না, কথা বলার সময় আইনস্টাইন যখনই চাইবেন মিলেভাকে চুপ করে যেতে হবে, কথার প্রতিবাদ বা তর্ক করা যাবে না।

ভেবে দেখুন, এভাবে কি কোনো সম্পর্ক টেকে?

এসবে ক্লান্ত মিলেভা, তার সঙ্গে ছিল বঞ্চনার ব্যথা। শিক্ষাজীবনে ছাত্র হিসেবে আইনস্টাইনের চেয়ে বরং মিলেভাই ভালো ছিলেন। আইনস্টাইনের গবেষণাতেও সহযোগিতা করেছেন। তাঁরও ইচ্ছা ছিল পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করার। আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম যখন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, মিলেভা তখন রান্নাঘরের হাঁড়ি সামলাচ্ছেন, মুখ বুজে সহ্য করছেন স্বামীর অন্যায় আবদার।

ঘরের এই অবস্থায় ‘চাইলে তিনিও পারতেন আলবার্ট আইনস্টাইন এর  মতো বিখ্যাত হতে’—এই বিষয়টি মিলেভাকে ঈর্ষাকাতর করে তুলেছিল। দোষ বলতে তাঁর এটুকুই।

দিনে দিনে এলসার সঙ্গে প্রেমটা আরও খোলামেলা হয়ে ওঠে আইনস্টাইনের। মিলেভা এসব সহ্য করতে না পেরে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে যান বার্লিন ছেড়ে জুরিখে। সেটা ১৯১৪ সাল। আলবার্ট আইনস্টাইনের তখন পোয়াবারো। বাসা নিলেন এলসাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি। এতে অবশ্য তাঁর সুবিধাই হলো, খাওয়া ও দেখভালের দায়িত্ব সব তুলে নিলেন এলসা নিজের কাঁধে। তিনি খুব করে চাইছিলেন আইনস্টাইন ও মিলেভার সম্পর্ক যেন বিচ্ছেদের দিকে যায়।

এ সবকিছুর মধ্যেও কিন্তু থেমে নেই আলবার্ট আইনস্টাইনের গবেষণা। তিনি তখন মগ্ন জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির রহস্য সন্ধানে। মগ্ন এলসার প্রেমেও। শুধু কি এলসা? শোনা যায়, আইনস্টাইন নাকি এলসার মেয়ের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এলসার বড় মেয়ে আইলস তখন আইনস্টাইনের সেক্রেটারি। গোপনে তাঁর সঙ্গেও অভিসার চলে আইনস্টাইনের।

এ বিষয়টা জানতেন স্বয়ং এলসাও। তিনি মেয়েকে বাধা দেন। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্মের আগমুহূর্তে মা-মেয়ে-আইনস্টাইন-মিলেভা চতুষ্টয়ে মানব প্রবৃত্তির জটিলতম খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল পৃথিবীতে।

শেষ পর্যন্ত আইলস তাঁর আরেক প্রেমিককে বিয়ে করে ফেলেন। এলসার পথ তখন পরিষ্কার। আইনস্টাইন তখন মিলেভাকে বিচ্ছেদের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু তিনি রাজি নন। কারণ, তাঁর ধারণা, বিচ্ছেদ হয়ে গেলেই আইনস্টাইন তাঁর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেবেন।

এছারাও আরও পড়ুনঃ আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবন, কিছু রহস্য, ট্র্যাজেডি ও সাফল্য

এবংঃ

তথ্যসূত্র: ‘দ্য প্রাইভেট লাইফ অব আলবার্ট আইনস্টাইন’