“ছেলের মানসিক সমস্যার কারণে খুব কঠিন সময় পার করেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন,” বলেন জেভ রোজেনক্রান্স, আইনস্টাইন পেপার্স প্রজেক্টের একজন সম্পাদক এবং উপ-পরিচালক।

আলবার্ট আইনস্টাইনের কনিষ্ঠ সন্তানের নাম ছিল এডুয়ার্ড। তাকে আদর করে ডাকা হতো টেট।

এডুয়ার্ড (বামে) এবং হান্স আলবার্ট আইনস্টাইন শিশু বয়সে।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

এডুয়ার্ড (বামে) এবং হান্স আলবার্ট আইনস্টাইন, শিশু বয়সে।

শিশু কালেই তার স্বাস্থ্য নিয়ে পরিবারের ভেতরে উদ্বেগ ছিল। তবে তার মানসিক সমস্যার কথা জানা যায় আরো অনেক পরে। “তার জীবন ছিল অত্যন্ত করুণ,” বলেন রোজেনক্রান্স।

আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী এবং পদার্থবিজ্ঞানী মিলেভা মারিচের সংসারে ছিল তিনটি সন্তান। তাদের কন্যা লিসেরেল সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, এবং তার জীবন অনেকটাই রহস্যাবৃত।

লিসেরেল ছিল তাদের সবচেয়ে বড় সন্তান। মেঝ সন্তান হান্স আলবার্ট তার জীবদ্দশাতেই বিজ্ঞানী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তবে পিতার মতো বিখ্যাত তিনি কখনোই হতে পারেন নি।

“আমার পিতার ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠার পেছনে কারণ হল তিনি খুব সহজে হাল ছাড়তেন না। কিছু কিছু সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। এমন কী কোন ভুল সমাধান হলেও। তিনি বারবার চেষ্টা করতেন। একবার না হলে আবার করতেন,” বলেন হান্স আলবার্ট।

“একমাত্র যে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন সেটা হচ্ছে আমি। তিনি আমাকে উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু খুব শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারেন যে আমি আসলে একজন একরোখা মানুষ এবং আমার পেছনে সময় দিলে সেটা হবে অপচয়,” বলেন তিনি।

প্রথম সন্তান, লিসেরেল

মিলেভা মারিচ ও আলবার্ট আইনস্টাইন বিবাহবন্ধনে জড়ানোর আগেই ১৯০২ সালে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছিল। এই কন্যা সন্তানের নাম ছিল লিসেরেল।

“দুই বছর বয়স হওয়ার পর তার কী হয়েছে সেবিষয়ে আমরা আসলেই কিছু জানি না,” বলেন রোজেনক্রান্স, “ইতিহাসে তিনি হারিয়ে গেছেন।”

আইনস্টাইন পেপার্স প্রজেক্ট তৈরিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন রোজেনক্রান্স। এই প্রকল্পের আওতায় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানীর শত শত দলিল ও কাগজপত্র সংগ্রহ করে সেগুলো অনুবাদ ও প্রকাশ করা হয়েছে।

ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি এই প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে এবং তাতে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি এবং হিব্রু ইউনিভার্সিটি অফ জেরুসালেম।

আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে তার স্ত্রী মিলেভা মারিচ। ছবিটি ১৯০৫ সালে তোলা।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে তার স্ত্রী মিলেভা মারিচ। ছবিটি ১৯০৫ সালে তোলা।

আইনস্টাইনের যেসব চিঠিপত্র এবং দলিলপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো থেকে তার মানবিক দিক সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।

এসব চিঠিপত্র থেকেই জানা যায় লিসেরেলের কথা।

“তার স্বাস্থ্য কি ভাল? সে কি ঠিকমতো কান্নাকাটি করে? তার চোখগুলো কেমন? আমাদের মধ্যে কার সঙ্গে তার বেশি মিল? কে তাকে দুধ খাওয়ায়? সে কি ক্ষুধার্ত? তার মাথা নিশ্চয়ই পুরোপুরি ন্যাড়া। আমি তাকে এখনও চিনি না কিন্তু এর মধ্যেই তাকে আমি অনেক ভালবাসি,” এসব কথাই সুইজারল্যান্ড থেকে আইনস্টাইন লিখেছেন মিলেভাকে, যিনি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য সার্বিয়াতে চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু শিশু জন্ম দেওয়ার জন্য তিনি কেন সুইজারল্যান্ড ছেড়ে যান?

“আইনস্টাইনের মা মিলেভার সঙ্গে তার সম্পর্ককে একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি,” বলেন হানচ গুটফ্রয়েন্ড, আইনস্টাইনের ওপর সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন তিনি।

গুটফ্রয়েন্ড বলেন, আইনস্টাইনের মা মনে করেছিলেন তার সন্তান ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে ফেলছে। “তিনি এমন হুমকিও দিয়েছিলেন যে মিলেভা যদি অন্তঃসত্ত্বা হন সেটা হবে একটা বিপর্যয়কর ঘটনা। সেসময় বিয়ের আগে সন্তান নেওয়া ছিল অনেক বড় কেলেঙ্কারি।”

ভায়োলিন বাজাচ্ছেন আইনস্টাইন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

সন্তানদের জন্য ভায়োলিন বাজাতেন আইনস্টাইন।

“তোমার জন্য আমার প্রেম”

কিন্তু বাস্তব ঘটনা হচ্ছে এই দুজনের মধ্যে প্রেম ছিল অনেক গভীর, বলেন গুটফ্রয়েন্ড। ধারণা করা হয় আইনস্টাইনের বয়স যখন ১৯ এবং মিলেভার বয়স ২৩ তখন তাদের মধ্যে এই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল।

এই দুজন পদার্থবিদ জুরিখ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করতেন। সেসময় সেখানে মিলেভা ছিলেন একমাত্র নারী শিক্ষার্থী। এছাড়াও তিনি ছিলেন দ্বিতীয় নারী যিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা শেষ করেছেন।

ওয়াল্টার আইজাকসন আইনস্টাইনের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। নাম আইনস্টাইন: তার জীবন ও মহাবিশ্ব। তিনি বলেন, “আইনস্টাইনের চিঠিপত্র থেকে মিলেভার প্রতি তার প্রেম ভালবাসা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। আমরা এও জানতে পারি যে আইনস্টাইনের মা বউ হিসেবে মিলেভাকে মেনে নিতে পারেন নি।”

একটি চিঠিতে লেখা: “আমার পিতামাতা এমনভাবে কাঁদতেন যেন আমি মারা গেছি। তারা বারবার একই অনুযোগ করতেন যে তোমাকে ভালবেসে আমি নিজের জন্য লজ্জা বয়ে এনেছি। তারা মনে করেন তোমার স্বাস্থ্য ভাল নয়।”

কিন্তু আইনস্টাইন তার হৃদয়ের কথাই শুনেছিলেন। মিলেভা যখন গর্ভধারণ করেছেন তখন তিনি তাকে একটি চিঠিতে লিখে একজন ভাল স্বামী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আলবার্ট আইনস্টাইন তার ছেলে হান্স আলবার্টের সঙ্গে ১৯৩৬ সালে।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

আলবার্ট আইনস্টাইন তার ছেলে হান্স আলবার্টের সঙ্গে ১৯৩৬ সালে।

আইনস্টাইন লিখেছেন: “আমাদের জন্য যেটা একমাত্র সমস্যা হয়ে থাকবে তা হলো লিসেরেলকে আমাদের সঙ্গে রাখা। আমি তাকে ত্যাগ করতে চাই না।”

আইনস্টাইন জানতেন তার সমাজে একজন “অবৈধ শিশুকে” সঙ্গে রাখা কতখানি কঠিন। এবং তার জন্য তো এটা আরো অনেক কঠিন ছিল কারণ তিনি সমাজে একজন সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছিলেন।

দীর্ঘ নীরবতা

মনে করা হয় যে আইনস্টাইনের সঙ্গে লিসেরেলের কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। মিলেভার যখন সুইজারল্যান্ডে ফিরে আসার সময় হয়, লিসেরেলকে তিনি সার্বিয়াতে তার আত্মীয় স্বজনের কাছে রেখে আসেন।

আইজাকসন ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে মিলেভার একজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হয়তো লিসেরেলকে দেখাশোনা করতো কিন্তু এই তথ্যও খুব একটা নিশ্চিত নয়।

“তাদের প্রেমপত্রগুলোতে যা কিছু লেখা হয়েছে সেগুলো থেকেই আমরা তাদের কন্যা সম্পর্কে জানতে পারি,” বলেন গুটফ্রয়েন্ড, “কিন্তু একটা সময় পর তার কথা আর কখনো উল্লেখ করা হয়নি।”

“অনেক ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক সার্বিয়াতে গিয়ে তার বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছেন, দলিলপত্র, রেকর্ড, আর্কাইভ- সব জায়গাতে তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তারা তেমন একটা সফল হননি,” বলেন রোজেনক্রান্স।

“তার কথা সবশেষ উল্লেখ করা হয় যখন তার বয়স দুই বছর। সেসময় তার জ্বর হয়েছিল। কিন্তু আমরা জানি না এর পরে সে বেঁচে ছিল কীনা,” বলেন তিনি।

এর পর তাকে নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা কল্পনা তৈরি হয়েছে: “হয়তো তাকে দত্তক দেওয়া হয়েছে, অথবা সে হয়তো মারা গেছে। আমরা ঠিক জানি না,” বলেন রোজেনক্রান্স।

ধারণা করা হয় যে আইনস্টাইন, যিনি ১৯৫৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি তার কন্যা সম্পর্কে কাউকে কখনও কিছু বলেন নি।

আইনস্টাইন পেপার্স প্রজেক্ট জানতে পেরেছে লিসারেল ১৯৮৬ সালেও বেঁচে ছিলেন। এসময় মিলেভার সাথে যেসব যোগাযোগ হয়েছে তার কিছু বিষয়ে এই প্রজেক্টে জানতে পেরেছে।

বই পড়ছেন আইনস্টাইন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

আইনস্টাইনের বয়স যখন ২৬।

নিজের বাড়ি

আইনস্টাইন ১৯০৩ সালে বের্ন শহরে একটি ভাল চাকরি পান, মিলেভা ফিরে আসেন সার্বিয়া থেকে, এবং এর পর তারা বিয়ে করেন।

পরের বছর তাদের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। এই পুত্র সন্তানের নাম ছিল হান্স আলবার্ট। তাদের তৃতীয় ও শেষ সন্তান ছিল এডুয়ার্ড, তার জন্ম ১৯১০ সালে। পরিবারটি জুরিখে চলে যাওয়ার পর তার জন্ম।

“আমার মা যখন বাড়িতে ব্যস্ত থাকতেন তখন আমার পিতা তার কাজ রেখে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের দেখাশোনা করতেন। আমাদেরকে তার হাঁটুর ওপর বসিয়ে তিনি দোল খাওয়াতেন। আমার মনে আছে তিনি আমাদের গল্প শোনাতেন এবং প্রায়শই ভায়োলিন বাজিয়ে আমাদের শান্ত রাখতে চেষ্টা করতেন,” এভাবেই হান্স আলবার্ট উল্লেখ করেছেন বলে জানান আইজাকসন।

এডুয়ার্ড: শারীরিক ও মানসিক সমস্যা

এডুয়ার্ডের শৈশবের শুরুর দিকে তার স্বাস্থ্য খারাপ ছিল, প্রায়শই সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তো এবং দীর্ঘ সময় বিছানায় পড়ে থাকতো।

একবার, ১৯১৭ সালে, যখন তার ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছিল, আইনস্টাইন তার এক বন্ধুকে লিখেছিলেন: “আমার ছোট শিশুর অবস্থা আমাকে বেশ বিষণ্ণ করে রাখে।”

এসব সত্ত্বেও “সে একজন দারুণ ছাত্র ছিল। শিল্পকলার ব্যাপারে তার বিশেষ আগ্রহ। সে কবিতা লিখে এবং পিয়ানো বাজায়,” আইনস্টাইনের ওপর এক গ্রন্থ ‘এন আইনস্টাইন এনসাইক্লোপিডিয়া’তে একথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এডুয়ার্ড তার পিতার সঙ্গে সঙ্গীত ও দর্শন বিষয়ে আলোচনা করতেন এবং আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন যে তার “ছেলে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করছে।”

ভালবাসার সমাপ্তি

আইনস্টাইন যতই তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে ডুবে যেতে লাগলেন ততই মিলেভার সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে লাগল। এসময় তার এক কাজিন এলসার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়।

পরিবারটি ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বার্লিনে বসবাস করত। কিন্তু মিলেভার প্রতি আইনস্টাইনের অবজ্ঞামূলক আচরণের কারণে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে তিক্ততা আরো বৃদ্ধি পায়। এবং এক পর্যায়ে মিলেভা তার সন্তানদের নিয়ে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান।

তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে ১৯১৯ সালে কিন্তু সন্তানদের কাছ থেকে দূরে থাকা আইনস্টাইনের জন্য খুব কষ্টকর ছিল, বলেন গুটফ্রয়েন্ড, ফলে তিনি তার দুই ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতেন।

“তিনি খুব স্নেহময় পিতা ছিলেন, ” বলেন রোজেনক্রান্স।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখনই পরিস্থিতি তৈরি হতো তিনি সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, ছুটিতে বেড়াতে নিয়ে যেতেন এবং “যখন তারা বড় হয়ে গেল, তাদেরকে তিনি বার্লিনে আমন্ত্রণ জানাতেন একসঙ্গে সময় কাটানোর জন্য।”

“তাদের দুজনের সঙ্গেই আইনস্টাইনের ভাল যোগাযোগ ছিল, বিশেষ করে ছোট ছেলের সঙ্গে, তার কিশোর বয়সে।”

বাগানে হাঁটছেন আইনস্টাইন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

আইনস্টাইন তার কন্যার কথা গোপন রেখে গেছেন।

তিনি বলেন, এডুয়ার্ডের সঙ্গে তার ঘন ঘন যোগাযোগ হতো এবং সেটা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ের। এমনকি তারা একে অপরের সমালোচনাও করতেন।

“এডুয়ার্ড আইনস্টাইনকে যা কিছুই পাঠাত সেটা তিনি খুব পছন্দ করতেন,” সেটা যে শুধু তার লেখার উপহার সেজন্য নয়, তার চিন্তার গভীরতার কারণেও।

আইনস্টাইন ১৯৩০ সালে তাকে লিখেছিলেন, “জীবন হচ্ছে একটা সাইকেল চালানোর মতো। ভারসাম্য রাখতে হলে সেটাকে চালাতে হবে।”

বড় ছেলে হান্স আলবার্টের সঙ্গে আইনস্টাইনের সম্পর্ক খুব বেশি গভীর ছিল না। হান্স ছিল অনেকটা মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ, বলেন রোজেনক্রান্স।

“বিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল কাজ, উদ্ভাবন, কারিগরি – এসব বিষয়ে তার ঝোঁক ছিল,” তার পিতার সঙ্গে খেলাধুলা থেকে এটা বোঝা যায়।

এর কয়েক বছর পর আইনস্টাইন তাকে যেসব চিঠি লিখতেন সেগুলোতে তিনি যে শুধু তার তত্ত্বের কথাই লিখতেন তা নয়, সেগুলো তিনি প্রমাণ করারও চেষ্টা করতেন। একই সঙ্গে কিভাবে একটি চাকরি সংগ্রহ করা যায় সেবিষয়েও তিনি পরামর্শ দিতেন।

রোগ নির্ণয়

এডুয়ার্ড আইনস্টাইন স্বপ্ন দেখতেন যে তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী হবেন এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েডর তত্ত্বের ব্যাপারে তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল।

তিনি যখন মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা করতেন, ১৯৩২ সালে, তাকে সুইজারল্যান্ডের একটি মানসিক চিকিৎসার ক্লিনিকে ভর্তি করাতে হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে, তার বয়স যখন ২২ তখন ধরা পড়ে যে তিনি মানসিক রোগ স্কিটসোফ্রিনিয়াতে আক্রান্ত।

“এতে আইনস্টাইন প্রচণ্ড কষ্ট পান,” বলেন গুটফ্রয়েন্ড।

“আমার দুটো ছেলের মধ্যে সবচেয়ে পরিমার্জিত, যাকে আমার নিজের চরিত্রের মতো বলে মনে হয়, সে অনিরাময়যোগ্য এক মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছে,” আইনস্টাইনের লেখা একটি চিঠিতে একথা উল্লেখ করা হয়েছে।

জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর উত্থান ঘটে ১৯৩৩ সালে। তখন তিনি জার্মানি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে বাধ্য হন।

“জার্মানি ছেড়ে যাওয়ার সামান্য আগে আইনস্টাইন এডুয়ার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সম্ভবত সেটাই ছিল তাদের শেষ দেখা,” একথা উল্লেখ করা হয়েছে এক আইনস্টাইন এনসাইক্লোপিডিয়াতে, “এর পর পিতা ও পুত্রের আর কখনো দেখা হয়নি।”

দুঃখজনক সমাপ্তি

মূলত মিলেভা-ই এডুয়ার্ডকে দেখাশোনা করতেন, কিন্তু যখন তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে থাকে- অথবা যখন মিলেভা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন- তখন তাকে একটি মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে থাকতে হয়েছিল।

মিলেভা মারা যান ১৯৪৮ সালে। এর পর এডুয়ার্ডকে দেখাশোনা করার জন্য তার একজন আইনগত অভিভাবক নিয়োগ করতে হয়েছিল যার খরচ দিতেন আইনস্টাইন।

“আমার মনে হয় না সেসময় পিতা ও পুত্রের মধ্যে কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়েছে,” বলেন রোজেনক্রান্স।

আইজাকসনের মতে, এডুয়ার্ডের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের যেতে অনুমতি দেওয়া হয়নি।

জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি একটি ক্লিনিকে কাটিয়েছেন এবং সেখানেই তিনি ১৯৬৫ সালে ৫৫ বছর বয়সে মারা যান।

দ্বিতীয় স্ত্রী এসলার সঙ্গে আইনস্টাইন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

দ্বিতীয় স্ত্রী এসলার সঙ্গে আইনস্টাইন।

হান্স আলবার্ট

আইনস্টাইনের দ্বিতীয় সন্তান হান্স আলবার্ট জুরিখে সুইস ফেডারেল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন।

“আমার আলবার্ট একজন সক্ষম ও দৃঢ় চরিত্রের ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে,” ১৯২৪ সালে একথা লিখেছেন গর্বিত আইনস্টাইন।

হান্স আলবার্ট ১৯২৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৩৬ সালের মধ্যে তিনি ডক্টর অব টেকনিক্যাল সায়েন্সেস উপাধি অর্জন করেন।

পিতার পরামর্শে ১৯৩৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে তার পড়াশোনা চালিয়ে যান।

তার পড়াশোনার বিষয় ছিল নদী এবং সেখানে পলিমাটির চলাচল।

নদীর পানি কিভাবে পলিমাটি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায় সে বিষয়ে আমরা বর্তমানে যা কিছু জানি তার ভিত্তি তৈরি করেছে এই হান্স আলবার্টের গবেষণা।

তার অবদানের প্রতি স্বীকৃতি জানাতে আমেরিকান সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স ১৯৮৮ সালে হান্স আলবার্ট আইনস্টাইন পুরষ্কার ঘোষণা করে।

হান্স বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

“তার মধ্যে কিছু বিষয়ের সমন্বয় ঘটেছিল যা খুবই বিরল। বিজ্ঞানের গবেষণায় তিনি খুব দক্ষ ছিলেন, একই সঙ্গে ছিলেন একজন প্রকৌশলী এবং একজন চমৎকার শিক্ষক।”

আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯৫৪ সালে লেখা এক চিঠিতে তার এ ছেলের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, “সে আমার চরিত্রের প্রধান দিকগুলো পেয়েছে: লক্ষ্য অর্জনে সে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োগ করতে পারে, একজন মানুষের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব।”

মতবিরোধ

সন্তানদের সঙ্গে আলবার্ট আইনস্টাইনের সম্পর্কে উত্থান পতন চোখে পড়ার মতো: কোন চিঠিতে তিনি খুব স্নেহপ্রবণ আবার কোন চিঠিতে তাকে খুব ঠাণ্ডা এবং জাজমেন্টাল বলে মনে হয়েছে।

“অন্যান্য পরিবারের মতোই, তাদের যেমন কঠিন সময় ছিল তেমনি ছিল ভাল সময়ও,” বলেন রোজেনক্রান্স, “হান্স আলবার্টের সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার সংঘাত হয়েছিল।”

কিশোর বয়সে হান্স আলবার্ট একবার তার পিতাকে বলেছিলেন যে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন এতে খুশি ছিলেন না।

পরের কয়েক বছরে এই বিরোধ আরো বড়তে থাকে: “প্রথমত হান্স আলবার্ট যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আইনস্টাইন তাকে পছন্দ করেন নি।”

এলোমেলো চুলে আইনস্টাইনের অতিপরিচিত এক ছবি।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

এলোমেলো চুলে আইনস্টাইনের অতিপরিচিত এক ছবি।

এই ঘটনায় মিলেভা আইনস্টাইনের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন কিন্তু হান্স আলবার্ট তাদের দুজনের মতামত উপেক্ষা করে ১৯২৭ সালে ভাষাবিজ্ঞানী ফ্রিয়েডা নেখ্টকে বিয়ে করেন।

পরে আইনস্টাইন সন্তানের সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং ফ্রিয়েডাকে পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের ঘরে তিনটি সন্তানের জন্ম হয়।

গুটফ্রয়েন্ডের মতে তারা দুজন একে অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করলেও তারা পৃথক জীবন যাপন করেছেন: হান্স আলবার্ট থাকতেন পশ্চিম উপকূলে আর আইনস্টাইন ছিলেন পশ্চিম উপকূলের প্রিন্সটনে।

“এছাড়াও, আইনস্টাইন এর মধ্যেই তার দ্বিতীয় সংসার শুরু করে দিয়েছেন (তার কাজিন এলসা এবং এলসার আগের ঘরের দুই কন্যাসহ), বলেন তিনি।

ফ্রিয়েডার মৃত্যুর পর হান্স আলবার্ট বায়োকেমিস্ট এলিজাবেথ রবোজকে বিয়ে করেন, যার সঙ্গে তিনি তার বাকি জীবন কাটিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি মারা যান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। তার বয়স হয়েছিল ৬৯।

আইনস্টাইন একবার মিলেভাকে বলেছিলেন “তার জীবনের অন্যতম ভাল একটি দিক হচ্ছে তার দুই সন্তান, যারা তার মৃত্যুর পরেও আইনস্টাইনের জীবন বহন করবে,” বলেন আইজাকসন।

কিন্তু বিখ্যাত এবং প্রতিভাবান ব্যক্তির সন্তান হিসেবে তাদের জীবন সহজ ছিল না। এডুয়ার্ড নিজেই লিখেছেন: “কখনও কখনও এরকম একজন গুরুত্বপূর্ণ পিতা থাকার সমস্যা আছে। কারণ তার নিজেকে খুব অগুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।”

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার এক বছর আগে হান্স আলবার্টের জন্ম হয়েছিল।

আলবার্ট আইনস্টাইন তার পরবর্তী জীবনে স্বীকার করেছেন মিলেভা কতো ভালভাবে তার সন্তানদের বড় করেছেন।

আমি মনে করি না যে আইনস্টাইন নিজেকে খুব ভাল একজন স্বামী হিসেবে মনে করতেন। আমার মনে হয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে স্বামীর চেয়ে পিতা হিসেবেই তিনি ভাল ভূমিকা পালন করেছেন,” বলেন রোজেনক্রান্স।

সূত্রঃ BBC

Like Our Facebook Page and See Our Videos on YouTube

 

ধন্যবাদ