ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স কী?
অজ্ঞাতে বা অনিচ্ছায় শরীর থেকে যে কোনও পরিমান মূত্র বেরিয়ে আসার ঘটনাকে চিকিত্সা পরিভাষায় মূত্রধারণগত অক্ষমতা বা ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স বলে। নানা কারণে এই সমস্যা হয়, যার মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে খুব সহজেই রোগ সেরে যায়। জীবনযাত্রার সামান্য পরিবর্তন থেকে শুরু করে ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের মতো নানা উপায়ের সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। বলে রাখা ভাল, সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এমন মহিলাদের মধ্যে সাধারণত এই রোগ বেশি দেখা গেলেও সন্তান হয়নি এমন মহিলা, শিশু ও পুরুষেরাও এই জাতীয় অক্ষমতাকর শিকার হতে পারেন।
এই রোগ কি সারে?
চিকিত্সাবিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আজকাল এই রোগে আক্রান্তদের নিরাময়ে নানা ব্যবস্থা হয়েছে। সুতরাং এই ধরনের সমস্যায় ভীত হয়ে পড়ার কোনও কারণ নেই। সংক্ষেপে বলা যায়, চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়ে মূত্র ধারণগত অক্ষমতায় ভুগছেন এমন প্রতিটি মানুষের উপসর্গের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
leek
প্রকার ভেদ
মূত্রধারণগত অক্ষমতা মৃদু ও তীব্র পর্যায়ের হতে পারে। মৃদু পর্যায়ে খুব সামান্য মূত্র বেরয় বলে তেমন অসুবিধে হয় না। তবে তীব্র পর্যায়ের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে পড়ে। বারবার কাপড়চোপড় পাল্টাতে হয়। শরীর থেকে বাজে গন্ধ বেরনোর সম্ভাবনায় আতঙ্কিত থাকতে হয়। অন্যদিকে রোগের প্রকৃতি অনুসারে এদের স্ট্রেস ইনকন্টিনেন্স ও আর্জ ইনকন্টিনেন্স এই দু’ভাগেও ভাগ করা হয়। মূত্রথলি বা ইউরিনারি ব্লাডারের মুখের দুর্বলতাজনিত কারণে স্ট্রেস ইনকন্টিনেন্স এবং মূত্রথলির দেওয়ালের অস্থিরতার কারণে আর্জ ইনকন্টিনেন্স হয়।
বিব্রতকর বলে অনেকেই সময়মতো ডাক্তারের কাছে যান না বলে শুনেছি।
ডাঃ ঘোষ– ঠিকই শুনছেন। কিছুদিন আগে করা একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্সে ভুগতে শুরু হওয়ার পরে গড়ে অন্তত ৫ বছর পরে মহিলারা চিকিত্সকের পরামর্শ নেন। এদের মধ্যে অনেকেই নিজের সমস্যার কথা প্রকাশে লজ্জা অনুভব করেন, কেউ কেউ মনে করেন সন্তানের জন্মদানের পরে এইরকম শারীরিক অসুবিধে প্রত্যাশিত এবং এই নিয়ে কিছু করার মানেই হয় না। অনেকে আবার দীর্ঘদিন ধরে টয়লেটে গিয়ে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করেন।
অন্য উপসর্গ
অনিচ্ছাকৃতভাবে মূত্র বেরিয়ে আসার পাশাপাশি এই রোগে আরও কয়েক ধরনের সমস্যা হতে পারে। যেমন, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বার প্রস্রাব করা, প্রস্রাব করতে গিয়ে যন্ত্রণা বা জটিলতা হওয়া। কারও কারও ক্ষেত্রে আকস্মিক ও অনিয়ন্ত্রিত প্রস্রাবের প্রকোপ হয়। এমনও হয় যে মূত্রথলি খালি করতে অসুবিধে হচ্ছে অথবা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রস্রাব বেরচ্ছে না কিংবা বেরোতে দেরি হচ্ছে।
রোগ হওয়ার কারণ
মূত্রধারণজনিত অক্ষমতা বিষয়ে বিশদে বুঝতে গেলে মূত্রথলি বা ব্লাডারের গঠন সম্পর্কিত কয়েকটি বিষয় জানা জরুরি। ব্লাডার ডেট্রুসর মাসল নামে এক ধরনের নমনীয় পেশি দিয়ে তৈরি। কিডনিতে তৈরি হওয়া মূত্র ইউরেটার বাহিত হয়ে এই থলিতে জমা হয়। জমা থাকার সময় মূত্থলির নিচে থাকা ইউরেথ্রাল স্ফিংটার নামে একটি আংটির আকারের পেশি সঙ্কুচিত অবস্থায় থেকে মূত্রকে ধরে রাখতে সাহায্য করে।
এছাড়াও শ্রোণীতল বা পেলভিক ফ্লোরের পেশির আংশিক সাহায্যের প্রয়োজন হয়। এরা যোনী, মলদ্বার ও মূত্রথলিকে যথাস্থানে ধরে রাখে। হাঁচি বা কাশির সময় তলপেটে পড়ে চাপ, প্রেসার ট্র্যান্সমিশন থিয়োরি অনুসারে মূত্রনালি ও মূত্রথলিতে বাহিত হয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে সমান প্রভাব ফেলে।
মূত্রথলির কার্যকলাপের নেপথ্যে মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশের এবং ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক উভয় ধরনের কাজের সমন্বয় প্রয়োজন। ইউরেথ্রাল স্ফিংটার পেশির দুটি অংশ। এদের কাজও আলাদা। অনৈচ্ছিক পেশিতে তৈরি অভ্যন্তরীণ স্ফিংটার মস্তিস্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিরবচ্ছিন্ন চাপের সাহায্যে এরা মূত্রথলির মুখ বন্ধ করে রাখে।
অন্যদিকে ঐচ্ছিক পেশিতে তৈরি বহিঃস্থ স্ফিংটার শ্রোণীতলকে সচেতন ভাবে চেপে রেখে মূত্রকে কিছুতেই বেরতে দেয় না। এই পেশির ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হল, খুব সঙ্কুচিত হয়ে থাকলে এরা অল্পে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে কারণে তিন-চার বার হাঁচি বা জোরে কাশি হলে সঙ্কোচন আলগা হয়ে গিয়ে মূত্র বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
মূত্রধারনগত অক্ষমতার সূত্রপাত
মূত্রথলির মুখ ও ইউরেথ্রাল স্ফিংটারের ক্ষতি হলে ভেতরের অংশ বন্ধ করে রাখার ব্যাপারে মূত্রথলি তার কার্যকারিতা হারায়। মূত্রথলি নিজে অস্থিত (আনস্টেবল) বা অতিসক্রিয় হতে পারে (ডেট্রুসর ইরিটেবিলিটি)। মস্তিস্কের যে অংশ মূত্রথলির কার্যকারীতার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত তার ক্ষতি হলেও সমস্যা বাড়ে।
সমস্যার কারণ
প্রসব এর সময় মূত্রথলির মুখ ও ইউরেথ্রাল স্ফিংটারের ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে মূত্রথলির ধারক কাঠামো দুর্বল হয়ে গেলে থলির মুখ নিচের দিকে নেমে এসে সমস্যা বাড়ায়। প্রসবকালীন সময় ছাড়াও ক্রনিক কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা ধূমপায়ীদের ক্রনিক কাশি থেকে এই ধরনের জটিলতা হতে পারে। মূত্রথলির অস্থিতি বা অতিসক্রিয়তার সঠিক কারণ জানা যায়নি।
তবে এই সমস্যার সঙ্গে মূত্রথলি খালি করার স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যাওয়া বা সন্তান প্রসবের কারণে স্নায়ুর ক্ষতি হওয়া বা মূত্রধারণের অক্ষমতাজনিত কোনও পূর্ববর্তী অস্ত্রোপচারের সম্পর্ক থাকতে পারে। স্ট্রোক বা মেরুদণ্ডের আঘাতে মূত্রথলির কার্যকারীতার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত মস্তিস্কের বিশেষ অংশের ক্ষতি হতে পারে।
এই সময় মস্তিস্কের উচ্চাংশের সঙ্গে সুষুম্নাকাণ্ডের নিম্নাংশের যোগাযোগ ব্যাহত হয়। এতে শৈশবের মূত্রথলি খালি করবার প্রতিবর্ত ধরণ (রিফ্লেক্স প্যাটার্ন) ফিরে আসে। থলির ওপরে যে কোনও ধরনের চাপে সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন, ফাইব্রয়েডস কিংবা কৌষ্ঠকাঠিন্যর কারণে মলদ্বারে জমে থাকা মলে সমস্যা বাড়ে।
কেন মহিলারা বেশি আক্রান্ত হন
আগেই জানিয়েছি, যে কোনও মানুষ মূত্রধারণ জনিত অক্ষমতার শিকার হতে পারেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলারাই এই রোগের শিকার হন। এর পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেমন, গর্ভধারণ, সন্তানের জন্মদান, মেনোপজ ও সংক্রমণ।
গর্ভধারণ
গর্ভসঞ্চারকালে একজন মহিলার শরীরে যে শারীরবৃত্তীয় ভিন্নতা আসে তার অন্যতম হল মূত্রথলি ও শ্রোণীদেশের পরিবর্তন। এই সময় কিডনি বেশি পরিমান মূত্র উত্পাদন করতে শুরু করলে বারে বারে প্রস্রাব করার প্রয়োজন হয়। অথচ অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকার কারণে থলি ঠিকমতো খালি হয় না।
এই কারণে ইউরিনারি ট্র্যাকে ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণ বেড়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে মূত্রধারণজনিত অক্ষমতার সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে, এই সময় জরায়ু প্রসারিত হয়ে মূত্রথলিতে বাড়তি চাপ দিতে শুরু করলে বেশি বার প্রস্রাব করার প্রয়োজন হয়। প্রায় এক তৃতীয়াংশ মহিলার ক্ষেত্রে এই বাড়তি চাপের কারণে তাদের অজান্তেই মূত্র বেরিয়ে আসে।
সমস্যাটি অবশ্য সন্তানপ্রসবের পরে ধীরে ধীরে চলে যায়। তবে শ্রোণীদেশের পেশি নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুসমূহ গর্ভধারণকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভবিষ্যতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
সন্তানের জন্মদান
সন্তান প্রসবকালে পেশি ও শ্রোণী সাহায্যকারী কাঠামোর ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। স্বাভাবিক জন্মদানের সময় যোনীপথের পাশের দেওয়াল এবং শ্রোণীতলের পেশি প্রসারিত হয়। এইসব ক্ষতিগ্রস্ত পেশি ও কলা সম্পূর্ণভাবে সেরে ওঠে না। তাই শেষ পর্যন্ত জরায়ুর স্থানচ্যুতি (প্রোল্যাপস) ঘটে। কাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। তবে সন্তানের সংখ্যা, প্রসবের ধরণ, গর্ভস্থ সন্তানের ওজন, প্রসব যন্ত্রণার সময়কাল, প্রসবকালীন চাপ প্রয়োগের ফলে জন্মদানের পরে শ্রোণী অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে পারে।
মেনোপজ
মহিলাদের পেলভিক কলাসমূহ ইস্ট্রোজেন সংবেদি হয়। মেনোপজের সময় ডিম্বাশয়ের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে রক্তে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা নাটকীয় ভাবে কমে যায়। এই হর্মোন মাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোণীদেশের পেশি ও কলা ধীরে ধীরে সরু হতে শুরু করে এবং পূর্ববর্তী ভার সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে যোনিদেশের স্থানচ্যুতি ঘটে।
সংক্রমণ
মহিলাদের শ্রোণীদেশের গঠন মূত্রথলিতে সংক্রমমের সম্ভাবনা বাড়ায়। মূত্রথলি ও মূত্রথলির মধ্যবর্তী পথটি তুলনামূলক ভাবে ছোট হওয়ায় ব্যাকটিরিয়ার পক্ষে মূত্রথলিতে প্রবেশ করে সহজে সংক্রমণ ঘটানো সম্ভব হয়।
Follow us on Facebook
See our videos on YouTube
Read More:
আলবার্ট আইনস্টাইনের এর যত প্রেম ও পরকীয়া
মানুষ সৃষ্টি মাটি থেকে, কোরআন এবং বিজ্ঞান এর প্রমাণ ও ব্যাখ্যা
অতীত ভোলার উপায় কী? কষ্ট কমানোর জন্য কি কি করতে হবে?
Some brain hacks that a Neuroscientist or a Psychologist knows.
Some of the most interesting facts about human behaviour?
কৃতজ্ঞতা- লেখার জন্য –কৌশিক রায় এবং- ছবির জন্য গুগল।